বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি: জামালপুরের বকশীগঞ্জে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষকসহ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে ভাটি খেওয়ারচর উচ্চ বিদ্যালয়। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

গত ১২ নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ জহুরুল হোসেন এই বিদ্যালয়ে আকম্মিক পরিদর্শনে গেলে ধরা পড়ে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র। বিশেষ করে শিক্ষকের অনুপস্থিতি ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পাওয়া যায়।
এনিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে থলের বিড়াল।


অনিয়মিত শিক্ষক উপস্থিতি, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই, অনুমোদনহীন প্রক্সি শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের জাল সনদসহ একের পর এক অনিয়মের কারণে ক্ষোভ ছড়িয়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে। দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই বিদ্যালয়কে রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী সহ সচেতন মহল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে মেরুরচর ইউনিয়নের অজপাড়া গ্রাম ভাটি খেওয়ারচরে প্রতিষ্ঠিত হয় ভাটি খেওয়ারচর উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, জাল সনদের মাধ্যমে মানহীন শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার নিম্নমুখী হওয়া, পরীক্ষা পরিচালনায় দুর্নীতি, এমনকি উন্নয়ন কাজেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
জাল সনদে শিক্ষক নিয়োগ যেন এই বিদ্যালয়ে রীতিতে পরিণত হয়েছে। বিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে সনদ ও অন্যান্য জাল জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধানের পকেট ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে এসব দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে জাল সনদে চাকুরী নেওয়ায় এই বিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
এছাড়াও আরও তিনজন শিক্ষকের সনদপত্র জাল বলে অভিযোগ রয়েছে যা সহকারী শিক্ষক রুমা আক্তারের এইচএসসির সনদে জিপিএ ১.৮০ এর জায়গায় জালিয়াতি মাধ্যমে জিপিএ ২.৮০ দেখানো হয়। অনলাইনে অনুসন্ধান করা হলে ২.৮০ এর স্থলে তার জিপিএ ১.৮০ পাওয়া যায়। জানতে চেয়ে অভিযুক্ত রুমা আক্তারকে ফোন দেওয়া হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সহকারী শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামের এসএসসির সনদ তৃতীয় বিভাগ হলেও সনদে ঘষামাজা করে প্রথম স্থান দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমার কোনো তৃতীয় বিভাগ নেই। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।
সহকারী শিক্ষক আতোয়ার রহমান এর স্নাতকের সনদপত্র জাল রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার সাথে কথা হলে তিনি জাল সনদের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
জাল সনদ থাকার পরও বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ এর সাক্ষরে এসব অভিযুক্ত শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক নিয়মিতভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকেন না কিন্তু হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর হয় নিয়মিতভাবে। শিক্ষার্থীদের দাবি, নির্ধারিত সময়মতো ক্লাস না হওয়ায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে তাদের। এ কারণে বিদ্যালয়ে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে কোচিং বাণিজ্য করা হয়। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে।
এই বিদ্যালয়ের পাঠদানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ক্লাসে পাঠদান না করিয়ে কতিপয় শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয়েই কোচিং বাণিজ্য করা হয়। শিক্ষকরা ক্লাস ফাঁকি দেওয়ায় দুইজন প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠদান চালানো হচ্ছে।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবু নোমান নুরুজ্জামান দায়িত্ব পান। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর অনিয়মের বিষয়গুলো বের হচ্ছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কতিপয় শিক্ষকের সঙ্গে যোগসাজশে অনিয়ম করে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়ের সভাপতির অনুমতি ছাড়াই একাধিকবার ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন ও অর্থ লেনদেন করার অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানেননা বিদ্যালয়ের সভাপতিকে। তিনি বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো আর্থিক লেনদেন করে থাকেন। কোনো শিক্ষক এসব প্রতিবাদ করলে তার বেতন বন্ধের হুমকি প্রদান করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান বিদ্যালয়ের সভাপতির অনুমতি ছাড়াই দুজন প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করালেও বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আশরাফ আলী অবৈধভাবে ছুটি ছাড়াই সপ্তাহে তিন চারদিন অনুপস্থিত থাকেন। তিনি সপরিবারে শেরপুর জেলা শহরে থাকেন। তাই মাঝে মধ্যে বিদ্যালয়ে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন।
একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ক্রমেই নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিক্ষকদের ক্লাস ফাঁকির কারণে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গেছে। পড়াশোনা নেই অথচ ফলাফলে নানা কারসাজি হচ্ছে।
স্থানীয় এক সমাজসেবক মির্জা আজম জানান, দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের পরিচালনা কমিটিতে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিরাজ করায় প্রকৃত শিক্ষা কার্যক্রমের বদলে স্বার্থের বিষয়টি এগিয়ে রয়েছে, স্কুলটির ফলাফল ভালোই হয়ে আসছিল কিন্তু বর্তমানে নিয়মিত ক্লাস না হওয়াই তেমন ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু নোমান নুরুজ্জামানকে অনিয়মের বিষয়ে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কোনো অনিয়ম বা ব্যাংক থেকে অর্থ লেনদেন হয়নি। যা করেছে পূর্বের প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ করেছেন। জাল সনদে শিক্ষক নিয়োগ তার হাত ধরেই হয়েছে। বিদ্যালয়ের সভাপতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে কোনো সভাপতি নেই।
এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজাদুর রহমান ভুঁইয়া জানান, বিদ্যালয়টিতে নানা অনিয়মের বিষয়টি খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ জহুরুল হোসেন বলেন, বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে ব্যাংক হিসাবে আর্থিক অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়াও শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিত, সভাপতিকে না জানিয়ে ব্যাংক থেকে অর্থ লেনদেন করার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করা হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available